নবজাগরণঃ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা
নবজাগরণ (সোনার বাংলাদেশ)
পৃথিবীতে এমন রাষ্ট্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যেখানে একজন ব্যক্তির ইতিহাস লিখলেই সমগ্র জাতির ইতিহাস লেখা হয়ে যায়, হ্যাঁ আমি বঙ্গবন্ধুর কথা বলছি, আমি ১৭ মার্চ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্ম নেওয়া শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বলছি। বাঙালি জাতির ইতিহাস হাজার বছরের সংগ্রামের ইতিহাস, দুঃশাসন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন ও প্রতিরোধের ইতিহাস। ইতিহাসের এই পথ পরিক্রমায় বাঙালির অধিকার রক্ষায় ব্রিটিশ ভারত থেকে ভারত বিভাজন এবং পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি যতোই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে ততোই তিনি গণমানুষের আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছেন। টুঙ্গিপাড়ায় বেড়ে ওঠা দুরন্ত মুজিব ছোটবেলাতেই ছিলেন দস্যি বালকদের নেতা। তখন কে জানত এই দস্যি বালকদের নেতাই একদিন বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা হিসাবে আবির্ভূত হবেন, নীতি আদর্শে দেশ-জাতিকে অতিক্রম করে হয়ে উঠবেন এক কালজয়ী বিশ্বনেতা। আমরা তারই নজির দেখতে পাই ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচিতির পর সম্মেলনে কক্ষে সেদিন অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। সম্মেলন কক্ষের প্রতিটি লোক আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়েছিলেন, এ তালি যেন থামবার নয়। বাঙালির প্রাণের নেতাকে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সেদিন এভাবেই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। করতালি স্থায়ী হয়েছিল তিন মিনিটেরও অধিক সময় ধরে। পরে আলজিয়ার্সের একমাত্র ইংরেজি দৈনিকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রায় এক পৃষ্ঠাব্যাপী বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হলো যার শিরোনাম ছিল, "দি লিডার উইদাউট বিয়ার্ড; নিদার ভিজিটেড এনি নাইট ক্লাব নর টাচড ড্রিংকস্ ইন লাইফ"। (শ্মশ্রু বিহীন নেতা; যিনি জীবনে নৈশ ক্লাবে যাননি কিংবা মদ স্পর্শ পর্যন্ত করেননি।)
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাক-হানাদার বাহিনী পরিচালিত ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ আর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ যেন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত নিঃস্ব প্রায় একটি দেশকে পুনর্গঠন, ভগ্ন অর্থনীতিকে সচল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধন, প্রশাসনকে পুনর্গঠন, জনগণের সার্বিক জীবনমানের উন্নয়ন, বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় এবং দেশের জন্য একটি সংবিধান প্রনয়ন করা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, কৃত্রিম খাদ্য সংকট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমবর্ধমান অবনতি। বঙ্গবন্ধু সরকারকে এক চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিলেও মুক্তিযুদ্ধকালে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র এরপরও অনেকের কাছে থেকে গিয়েছিল। ফলে সশস্ত্র ডাকাতি, লুটতরাজ, ছিনতাই, পরিত্যক্ত বাড়িঘর দখলের মতো সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড চলতে থাকে। উপর্যুপরি বন্যা, খরা প্রভৃতি কারণে দেশে খাদ্য সংকট সৃষ্টি, বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করে সংকট মোকাবেলায় গৃহীত প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচের মধ্যে পড়ে বিপন্ন হওয়ায় দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টা বারেবারে হোটচ খেয়েছে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের জনসভায় তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, "বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা হবে। শোষকদের আর বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না। কোন ভুঁড়িওয়ালা এ দেশে সম্পদ লুটতে পারবে না। গরিবরাই হবে এই রাষ্ট্র এবং এই সম্পদের মালিক, শোষকরা হবে না। এই রাষ্ট্রে হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ থাকবে না। এই রাষ্ট্রের মানুষ হবে বাঙালি। তাদের মূলমন্ত্র-সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। এজন্য কাগজকে আমি মতামত প্রকাশের পূর্ণ অধিকার দিয়েছি।"
শুরু হলো বাংলাদেশ বিনির্মানের অভিযাত্রা। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যদের দেশে ফেরত পাঠানো, মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে আশ্রয় নেওয়া ১ কোটি শরণার্থীদের পুনর্বাসন, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের দেশে-বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা, কয়েক লক্ষ নির্যাতিত মা-বোনের পুনর্বাসন, পাকিস্তানে আটকেপড়া কয়েক লক্ষ বাঙালিকে দেশে ফেরত আনা, ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতু মেরামত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন, চট্টগ্রাম ও চালনা সমুদ্র বন্দর থেকে মাইন অপসারণ, নবগঠিত রাষ্ট্রের জন্য সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীসহ প্রতিরক্ষা বাহিনী পুনর্গঠন, শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিজ্ঞানভিত্তিক, গণমুখী ও যুগোপযোগী করে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন, ৪০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ ও কয়েক লক্ষ শিক্ষককে সরকারি মর্যাদা প্রদান, ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, কমনওয়েলথ ও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ব্যবস্থা, বিশ্বের শতাধিক রাষ্ট্রের নিকট হতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন, দ্রুত আত্মনির্ভরশীল জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালেই দেশের সকল ব্যাংক-বীমা, পাট ও বস্ত্রকলসহ বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ করেন। পুঁজির ঊর্ধ্বতম সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ এবং জমির ঊর্ধ্বসীমা পরিবার পিছু ১০০ বিঘা নির্ধারণসহ ভূমি সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। মোট কথা রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় এমন সকল বিষয়েই তিনি স্পর্শ করে গেছেন, প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, সূচনা করে গেছেন।
এতো কিছু সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিরোধী অপতৎপরতা অব্যাহত থাকে। প্রশাসনের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা পাকিস্তানপন্থীরা বঙ্গবন্ধুর উন্নয়নের নবজাগরণকে কালিমা লেপন করতে থাকে। কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে সর্তক করে বলেছিলেন, "আপনি বাংলাদেশে একটা পরাজিত প্রশাসনকে আইন সঙ্গত করেছেন। এক্সেলেন্সি, আপনি কিন্তু নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছেন।" ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে মুজিব-ক্যাস্ত্রোর আলোচনায় সেদিন ক্যাস্ত্রো আরো বলেছিলেন, "আইনজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ-এসব পেশার নেতৃত্বস্থানীয়দের এনে সরকারি প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দিন, এঁরা ভুলের পর ভুল করে সঠিক শিক্ষা লাভ করবে কিন্তু এঁরা ষড়যন্ত্র করবে না। পরম করুণাময়ের দোহাই দিয়ে বলছি আপনার মুক্তিযোদ্ধা ছেলেদের আরও বেশি করে দায়িত্ব দিন এবং সম্পূর্ণভাবে ওদের বিশ্বাস করুন। অন্যথায় আপনি নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছেন এক্সেলেন্সি।" বিদায় বেলায় ক্যাস্ত্রো শেখ মুজিবকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, "কমরেড মুজিব, আমি তোমায় ভালোবাসি - আমি তোমায় ভালোবাসি। আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি।"
শোষিত বঞ্চিত নিষ্পেষিত মানুষের পাশে থেকে থেকে গণমানুষের মনে স্থান পাওয়া বঙ্গবন্ধু জনগণের ভালোবাসাকেই বড় করে দেখেছিলেন সেদিন। অপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন একজন পিতা যেমন সন্তানের সকল অপরাধ ক্ষমা করে দেন। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "আপনার শক্তি কোথায়?" বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেছিলেন, "আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি।" "আর আপনার দুর্বল দিকটা কী?" বঙ্গবন্ধুর উত্তর, "আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি।" আজ ভাবতে বড় দুঃখ হয় এমন মহান নেতার ভালোবাসার প্রতিদান জাতি হিসাবে আমরা আজও দিতে পারিনি।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে মাত্র সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে তিনি হারে হারে উপলব্ধি করেছিলেন আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার অন্যতম বাধা হচ্ছে দুর্নীতি। ঠিক একারণেই বঙ্গবন্ধু তার বিভিন্ন বক্তব্য, বিবৃতিতে ও লেখায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অবস্থান সুস্পষ্ট করেছিলেন। দেশ পুনর্গঠনে দুর্নীতি যে বিরাট একটি অন্তরায় এবং দুর্নীতির সঙ্গে যে মূলত শিক্ষিত সমাজের ক্ষুদ্রতম অংশ জড়িত, সে বিষয়টি তিনি একাধিকবার উচ্চারণ করার পাশাপাশি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সতর্ক করে আত্মশুদ্ধির উপদেশ ও আহ্বান জানিয়েছিলেন। ১৫ আগষ্ট, ১৯৭৫ সালে ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে নির্মমভাবে স্বপরিবারে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি জাতির মানুষকে বারেবারে দুর্নীতি পরিহার করে সৎভাবে জীবনযাপন করার তাগিদ দিয়েছেন। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সততা ও নিষ্ঠার সাথে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। ২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫ সালে জাতীয় সংসদে প্রদত্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ, যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন। আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান—করাপশন। খাদ্য কিনতে যান—করাপশন। জিনিস কিনতে যান—করাপশন। বিদেশে গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে পাঁচ পারসেন্ট শিক্ষিত সমাজ, আর আমরাই করি বক্তৃতা। আমরা লিখি খবরের কাগজে, আমরাই বড়াই করি। আজ আত্মসমালোচনার দিন এসেছে। এসব চলতে পারে না। মানুষকে একদিন মরতে হবে। কবরে যেতে হবে। কিছুই সে নিয়ে যাবে না। তবু মানুষ ভুলে যায় কী করে এ অন্যায় কাজ করতে পারে। আর এই দুঃখী মানুষ যে রক্ত দিয়েছে, স্বাধীনতা এনেছে, তাদের রক্তে বিদেশ থেকে খাবার আনিয়ে সেই খাবার চুরি করে খাবে; অর্থ আনব, চুরি করে খাবে; টাকা আনব, তা বিদেশে চালান দেবে। বাংলার মাটি থেকে এদের উৎখাত করতে হবে। আজ দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, কালোবাজারি নতুন পয়সাওয়ালা—এদের কাছে আমার আত্মবিক্রি করতে হবে, এদের অধিকারের নামে আমাদের এদেরকে ফ্রি-স্টাইলে ছেড়ে দিতে হবে। কখনো না। কোনো দেশ কোনো যুগে তা দেয় নাই। দিতে পারে না। যারা আজকে আমার মাল বিদেশে চালান দেয়, চোরাকারবারি করে, যারা দুর্নীতি করে, এদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। মানুষকে যারা পয়সা দেয়, তোমার মাহিনা দেয়, তোমার সংসার চালানোর জন্য ট্যাক্স দেয়, তার কাছে তুমি আবার পয়সা খাও! মেন্টালিটি চেইঞ্জ করতে হবে। সরকারি কর্মচারী, মন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট আমরা জনগণের সেবক, আমরা জনগণের মাস্টার নই। মেন্টালিটি আমাদের চেইঞ্জ করতে হবে। আর যাদের পয়সায় আমাদের সংসার চলে, যাদের পয়সায় আমরা গাড়ি চড়ি, যাদের পয়সায় আমরা পেট্রোল খরচ করি, আমরা কার্পেট ব্যবহার করি, তাদের জন্য কী করলাম? সেটাই আজ বড় জিনিস। এত বড় দুধর্ষ, এত বড় শক্তিমান, এত বড় বন্দুক, এত কামান, এত মেশিনগান, এত পাকিস্তানি সৈন্য, এত বড় তথাকথিত শক্তিশালী আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, ইসকান্দার মির্জা, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী বাংলার মানুষকে অত্যাচার করতে চেষ্টা করেছে বন্দুক দিয়ে, তার বিরুদ্ধে বিনা অস্ত্রে আপনাদের নিয়ে সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত যদি উৎখাত করতে পারি, তাহলে কিছু দুর্নীতিবাজ, কিছু ঘুষখোর, কিছু শোষক, কিছু ব্ল্যাক মার্কেটিয়ার্স বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে পারব না—এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।’ ঐ একই তারিখে সংসদের অপর অধিবেশনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু মাননীয় স্পিকারকে উদ্দেশ করে উপরোক্ত বক্তব্য পুনর্ব্যক্ত করে আহ্বান জানিয়েছিলেন, "দেশকে বাঁচান, মানুষকে বাঁচান, মানুষের দুঃখ দূর করুন। আর দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাকারবারিদের উৎখাত করুন।"
আজও যখন আমরা পত্রপত্রিকায় দেখি সামান্য একজন সরকারি চাকরিজীবী শত কোটি টাকার মালিক। শতশত কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দুই টাকা জিনিস লক্ষ টাকায় কেনা হচ্ছে তখন বঙ্গবন্ধুকে খুব মনে পড়ে যায়। ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দু'লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের কথা মনে পড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, "আমি যখন থাকুম না, তখন আমার দাম বুঝবেন। বটগাছ পইড়্যা গেলে হাওয়ার দাপট টের পাইবেন।" জাতি আজ হাওয়ার দাপট টের পাচ্ছে। আমাদের এই ক্রান্তিকাল পার করতে হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশকেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে জাতির জনক বলেছিলেন, "আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম—ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি আমার বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।...যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে। আপনারা জানেন, আমি সমস্ত জনগণকে চাই, যেখানে রাস্তা ভেঙে গেছে, নিজেরা রাস্তা করতে শুরু করে দেও। আমি চাই জমিতে যাও, ধান বোনাও, কর্মচারীদের বলে দেবার চাই, একজনও ঘুষ খাবেন না, ঘুষখোরদের আমি ক্ষমা করব না।" জাতির পিতার এই আজ্ঞাকে শিরোধার্য হিসাবে নিয়ে আমাদের আগামী দিনের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। দুর্নীতিকে আমাদের রুখে দিতে হবেই হবে।
২০২০ সাল, কোভিড-১৯ এর দুর্যোগময় সময়ের মধ্য দিয়ে জাতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপন করছে। এখনই সময় জাতি হিসাবে আমদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বিশ্বায়নের এই ধারায় টিকে থাকতে হলে শুধু শ্রমনির্ভরতাই যথেষ্ট নয়। আমাদের মেধাকে কাজে লাগাতে হবে। যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাজনীতির কলুষতা মুক্ত করে গবেষণার অবাদ ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। সৃজনশীল কর্মকে বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতির ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ও জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। নিখাঁদ জাতিসত্বাবোধ জাগ্রত করে দেশের আপামর জনসাধারণের নৈতিকতা চর্চার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রশাসন যন্ত্রকে ঠেলে সাজাতে হবে, আরও জনবান্ধব করতে হবে। বঙ্গবন্ধু একটি সুখী, সমৃদ্ধ, শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে অবজ্ঞা করা হতো। সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। ইতোমধ্যে আমরা নিম্ন আয়ের দেশ হতে মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ করেছি। সামনে আগাতে হবে আরও অনেকটা পথ। জাতি হিসাবে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ আমাদের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারবে না। বিদেশি কোন ষড়যন্ত্রই আমাদের টলাতে পারবে না। দেশে উন্নয়নের যে নবজাগরণ শুরু হয়েছে কেউ তা রোধ করতে পারবে না। এখনই সময় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের। এ দেশ হবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ শান্তিপূর্ণ আবাসভূমি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
গ্রন্থপঞ্জিঃ মুজিবের রক্ত লাল, এম আর আখতার মুকুল; অসমাপ্ত আত্মজীবনী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ; বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সমগ্র; উইকিপিডিয়া, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিন।
=0=




